২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ ইং সনে নবম সংসদীয় নির্বাচন হয়। আওয়ামী লীগ মহাজোট গঠন করে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জনের সরকার গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশনকে পুনর্গঠন করে। উক্ত দলের নির্বাচনী ইশতিহারে ছিল দুর্নীতি দমন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা। কার্যতঃ ২০০৭-০৮ সালে আওয়ামী লীগের যেসব নেতৃস্থানীয়রা দুর্নীতির মামলার আসামি হয়েছিলেন, দোষী হয়েছিলেন তাদের রোষানলে পতিত হয় দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক।
২০০৭-০৮ সালে নিস্তেজ থাকা আমলা দুর্নীতিবাজরা আবার চাঙ্গা হয়ে উঠে। দুদকে নিজস্ব জনবল অনুপ্রবেশ করানোর পুরো সুযোগ নেয় নবগঠিত সরকার। এমনকি আইনী জটিলতা সৃষ্টি করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বাঁচিয়ে রাখার কালো আইন সংযোজন করে দুদক আইন সংশোধন করতে উঠেপড়ে লেগে যায় প্রশাসনিক দুর্নীতিবাজ আমলারা।
আমলাতোষণ এবং মারপ্যাঁচ করে দুর্নীতিবাজ আমলা পোষণ মনোবৃত্তির কালো আইন সংযোজন করলে দেশ ও দশের অকল্যাণ ডেকে আনা হবে। বলা যায়, সব মিলে দুদক এখন শিথিল অবস্থায় আছে। ৯ম সংসদীয় সরকারের আমলে মাত্র এক দফা জনবল সংযোজন করা হয়। পরবর্তীতে দুর্নীতির হালচিত্র আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। ওপেন সিক্রেট দুর্নীতি চললেও এর প্রতিকারে কঠোর ব্যবস্থা দেখা যায়নি আ.লীগ সরকারের।
দুদকের কাঠামো ও অপ্রতুল জনবল :
২০০৪ সনে দুদক আইন পাশের পর জেলাভিত্তিক অফিস আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলা হয়। যেখানে জেলাভিত্তিক অফিস সক্রিয় রেখেও পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেতো না, সেখানে গৃহীত হয় অফিসের সংখ্যা কমানোর রহস্যজনক পদক্ষেপ। একাধিক জেলা মিলিয়ে একটি অফিস সৃষ্টি করে নাম দেয়া হয় সমন্বিত জেলা কার্যালয়। এরকম মাত্র ২২টি সমন্বিত জেলা কার্যালয় রয়েছে সারা বাংলাদেশে। বিভাগীয় কার্যালয় রয়েছে ৬টি। বিভাগীয় কার্যালয়ের প্রধান হচ্ছেন পরিচালক। সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের প্রধান হচ্ছেন উপ-পরিচালক। তার উপরে রয়েছেন ৬জন মহাপরিচালক। এই মহাপরিচালকগণ হচ্ছেন লিগ্যাল এন্ড প্রসিকিউসন, প্রশাসন, সংস্থাপন ও অর্থ, অনুসন্ধান ও তদন্ত, বিশেষ অনুসন্ধান ও তদন্ত, গবেষণা পরীক্ষণ প্রতিরোধ ও গণসচেতনতা, অনি®পন্ন বিষয়াদি ও পরিদর্শন এই ছয় ভাগে বিভক্ত করে দায়িত্ব বণ্টন হয়েছে। তবে ৬জন মহা-পরিচালককে একত্রে কাজ করতে দেখা যায়না। বর্তমানে রয়েছেন ৪জন। কাজ করেন ৬ জনের। মহাপরিচালকের উপরের স্তরে ১৯ জন রয়েছেন সচিব তার উপরে কমিশনার ও চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান নিজেও একজন কমিশনার। বস্তুত দুদকে এখন যে জনবল রয়েছে তার হাজার গুণ বেশি জনবল প্রয়োজন এবং জেলা ভিত্তিক অফিস, সর্বোপরি সর্বগ্রাসী দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলার প্রয়োজনে উপজেলাভিত্তিক অফিস গঠন অপরিহার্য।
দুর্নীতির মামলা বিচারের আদালতসমূহ :
সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত :
দুর্নীতির অপরাধ আমলে গ্রহণের একক ক্ষমতা সিনিয়র স্পেশাল জজ-এর এখতিয়ারাধীন। দুর্নীতির অভিযোগের সকল মামলার নথি উপস্থাপিত হয় সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে অর্থাৎ দায়রা জজ আদালতে। সিনিয়র স্পেশাল জজ অপরাধ আমলে গ্রহণ করে মামলার নথি বিচারের জন্য প্রস্তুত করে নিজে অথবা অপরাপর স্পেশাল জজ আদালতসমূহে পাঠিয়ে দিতে পারেন। অপরাপর আদালত সমূহ হলো- স্পেশাল জজ অর্থাৎ অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত, যুগ্ম দায়রা জজ আদালত এবং ডিভিশন্যাল স্পেশাল জজ আদালত।
স্পেশাল জজ বা অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত :
জেলার প্রত্যেক অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালত এক একজন স্পেশাল জজ আদালত। সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত কর্তৃক মামলা বদলী করে দেয়া হলে সে মামলার বিচার স্পেশাল জজ হিসেবে অতিরিক্ত দায়রা জজ করতে পারেন।
স্পেশাল জজ বা যুগ্ম দায়রা জজ আদালত :
সরকারি গেজেট অনুসরণে নির্দিষ্ট যুগ্ম দায়রা জজও এক একজন স্পেশাল জজ আদালত। সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত হতে মামলার নথি প্রাপ্ত হয়ে তিনি গৃহীত মামলার বিচার করতে পারেন স্পেশাল জজ হিসেবে।
ডিভিশনাল স্পেশাল জজ আদালত :
প্রত্যেক বিভাগে ডিভিশনাল স্পেশাল জজ পদে একজন দায়রা জজ পদমর্যাদা সম্পন্ন বিচারকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। বিভাগভুক্ত জেলা হতে সিনিয়র স্পেশাল জজগণ মামলা বিচারের জন্য পাঠালে তারা বিভাগীয় শহরে বসে বিচার করেন। বিচার বিভাগ পৃথক হবার পর পূর্বতন এই বিন্যাসায়ন আরো সুবিন্যস্ত হবার দাবি রাখে।
দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তপ্রক্রিয়া :
দুর্নীতির অভিযোগ দায়ের : দুর্নীতির অভিযোগ দায়েরের জন্য সাদা কাগজে লিখিত একটি দরখাস্ত হলেই হয়। দরখাস্তটি সরাসরি দুর্নীতি দমন কমিশন অফিসে, বিভাগীয় অফিসে বা সমন্বিত জেলা অফিসে দাখিল করা যায়। ডাকযোগেও পাঠিয়ে দেয়া যায়। দুদক এসব দরখাস্ত যাচাই-বাছাই করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অ্যাকশনে যায়। স্তরভিত্তিক বাছাই শেষে দরখাস্ত, সংশ্লিষ্ট কমিশনার এর নিকট উপস্থাপন করা হয় পরবর্তী সিদ্ধান্ত প্রাপ্তির জন্য। অন্যদিকে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইনের তফসিলে উল্লেখিত অপরাধ বিষয়ে থানা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মামলা রেকর্ডে অর্থাৎ এজাহাররূপে গ্রহণ করায় আইনগত কোন বাধা নেই। এইরূপ এজাহার রেকর্ড করে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মামলা তদন্তের ব্যবস্থা করার জন্য এজাহার রেকর্ডের দুই কর্মদিবসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ পরিচালকের নিকট পাঠিয়ে দেবার আইনগত নির্দেশ রয়েছে।
দুর্নীতির অভিযোগ-এর অনুসন্ধান :
দুর্নীতি দমন বিধিমালা ২০০৭-এর তৃতীয় অধ্যায়ে রয়েছে অনুসন্ধান। দুর্নীতির অভিযোগ সম্বলিত দরখাস্ত ই,আর (ইনকোয়ারী রেজিস্ট্রার) নম্বরভুক্ত করে সংশ্লিষ্ট কমিশনার কর্তৃক বিবেচ্য গণ্য হলে তিনি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নিকট নির্দেশসহ পাঠাবেন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান সমাপ্ত করে প্রতিবেদন ফরম নং ২-এর বিবরণী উল্লেখপূর্বক নিয়ন্ত্রণকারী কর্মকর্তার নিকট দাখিল করবেন। কার্যকারণে ১৫ দিনের সময়সীমা শেষ হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিচালক হতে আরও ১৫ দিন বাড়ানো যায়। নিয়োগকৃত অনুসন্ধান কর্মকর্তার কার্যাবলি তদারকির জন্য উপপরিচালক পদ মর্যাদার একজন তদারককারী কর্মকর্তাও নিয়োগ করা হবে। অনুসন্ধান চলাকালে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা মনে করলে অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বক্তব্য জানতে লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করতে পারবেন। এইরূপ মৌখিক বা লিখিত বক্তব্য প্রদানে অভিযোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে। অনুসন্ধানের ফলাফল সম্বলিত মাসিক প্রতিবেদন ফরম নং-০৮ ব্যবহারে সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালক বরাবরে প্রেরণ করা হবে। প্রাপ্ত প্রতিবেদন দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনারকে অবহিত করা হবে। অনুসন্ধানের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে কর্তৃপক্ষের আদেশে মামলা রুজু করা হয় অর্থাৎ সংশ্লিষ্ট থানায় এজাহার করা হয়। এভাবেই অনুসন্ধান পর্বের নিঃশেষকরণের মাধ্যমে শুরু হয় তদন্তপর্ব।
দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত :
বিধিমালার চতুর্থ অধ্যায়ে তদন্ত সম্পর্কে আলোচনা ও দিকনির্দেশনা রয়েছে। তদন্ত কার্যক্রম তদারকির জন্য আগের মতই উপপরিচালকের নীচে নন এমন একজন কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। তদন্তকালে পুলিশী তদন্তের মতই তদন্তকারী কর্মকর্তাকে সি,ডি বা কেইস ডায়েরি তৈরি করতে হয়। তদন্ত শেষ হলে অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদনের সাথে অনুমোদনের জন্য সি,ডিও উপস্থাপন করতে হয়। তদন্তকালে ফৌজদারি কার্যবিধির অধ্যায় চৌদ্দ ভিত্তিক তদন্ত ছাড়াও বিধিমালার ৭নং ফরম পূরণ করে দৈনন্দিন তদন্তকাজ লিপিবদ্ধ করে রাখতে হয়। অনুসন্ধান শেষে প্রারম্ভিক সত্যতা ভিত্তিতে দায়ের হয় এজাহার। এজাহার ভিত্তিক তদন্ত শেষে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেলে দাখিল হয় কমিশনের অনুমোদনসহ অভিযোগপত্র। তদন্তকালে প্রয়োজন মনে করলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নোটিশ করে তার মৌখিক বা লিখিত বক্তব্য গ্রহণ করা যায়। নোটিশপ্রাপ্ত অভিযুক্ত ব্যক্তি আনিত অভিযোগ খন্ডন করে ব্যক্তিগতভাবে বা আইনজীবীর সাহায্যে মৌখিক বা লিখিত বক্তব্য পেশ করতে পারে তদন্ত কর্মকর্তার বরাবরে। তদন্তের ফলাফল অনুসন্ধান প্রতিবেদনের মতই ৮নং ফরমে মাসিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করতে হয়। (চলবে)
নিউজটি আপডেট করেছেন : SunamKantha